আধিপত্য (Hegemony) হচ্ছে গ্রিক ভাষায় হেগেমন থেকে উৎপন্ন ইংরেজি হেজিমনির বাংলা প্রতিশব্দ। প্রত্যয়টির অর্থ জটিল। দুটি বিপরীত অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়। একটির অর্থ হলো জবরদস্তিমূলক আধিপত্য। অপরটি নেতৃত্ব, যার ভিতরে সম্মতি প্রচ্ছন্ন থাকে। কোনো শ্রেণী বা রাষ্ট্রের দ্বারা অন্যান্য শ্রেণী বা রাষ্ট্রের উপর প্রভুত্ব করাকে আধিপত্য বলা হয়।
উনিশ শতকে ইউরােপে এক রাষ্ট্রের উপর অপর রাষ্ট্রের প্রভাব অর্থে হেজিমনিজম বা প্রভুত্ববাদ কথাটির প্রচলন ঘটে। সেই সময় কথাটির তাৎপর্য ছিল যে এক রাষ্ট্র কীভাবে তার উপর নির্ভরশীল অথবা প্রতিবেশী অন্য দুর্বল রাষ্ট্রকে প্রভুত্বে দাবিয়ে রাখে তারই রাজনীতি। বিশ শতকে সামরিক বাজেট বাড়িয়ে নিপীড়িত দেশগুলোর উপর প্রভুত্ব করা হয়। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি বিশ্বের মোট সামরিক বাজেটের ৭০% এরও বেশি সামরিক ব্যয় করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র ২০০৮ সালে ৪২% বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় হিসাব করেছিল।
মার্কসীয় ধারায় একটি রাষ্ট্র আর একটি রাষ্ট্রের উপর যে আধিপত্য চালায় সেটা প্রকৃত অর্থে সাম্রাজ্যবাদী নয়। নেতৃত্বের অর্থে প্রত্যয়টির ব্যবহার মার্কসীয় রাজনীতিতে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। লেনিন ও মেনশেভিকরা এই প্রত্যয়টির দ্বারা বােঝাতেন কীভাবে গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষকদের সঙ্গে মিতালি ও শ্রমিকদের নেতৃত্বের প্রভাবাধীনে কৃষকদের নিয়ে আসা হবে। বুখারিন এবং স্তালিনও কুড়ির দশকে প্রত্যয়টিকে ব্যবহার করতেন। তবে প্রত্যয়টিকে পুরােপুরি মার্কসীয় দৃষ্টিতে দাঁড় করিয়েছিলেন আন্তোনিও গ্রামসি।
রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে ভিন্ন অর্থে গ্রামসি শব্দটির উপর যে ব্যঞ্জনা আরােপ করেন তার মর্মার্থ হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ছাড়াও সামাজিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বাপারে একটি শ্রেণীর উত্থান, যে শ্রেণী তার উত্থানের অনুকূলে অন্যান্য শ্রেণীকে প্রবৃত্ত করতে সক্ষম।
কারাগারে লিখিত নিবন্ধে তিনি প্রত্যয়টিকে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের উৎখাতের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর অন্যান্য শ্রেণীর সঙ্গে মিতালি পাতানাের এক কৌশল হিসেবে উল্লেখ করেছেন; তার জন্য তিনি সােভিয়েত দেশের শ্রমিকদের নিজ স্বার্থে কৃষকদের অনুকূলে ত্যাগ স্বীকারের কথা বলেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সমসাময়িক অধিবেশনে গ্রামসি তাঁর তত্ত্ব সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর মতে একটি শ্রেণী কেবল তার সাংগঠনিক শক্তি দ্বারাই আধিপত্য করে না; সেই শ্রেণী তার সংকীর্ণ সাংগঠনিক স্বার্থের উর্ধ্বে নৈতিক ও মননশীল নেতৃত্বের সাহায্যে প্রভাব বিস্তার করে, সেজন্য প্রয়ােজনে সীমিত আপোস করতে হয় বিচিত্র শক্তি সমুচয়ের সঙ্গে, যাকে গ্রামসি ঐতিহাসিক গােষ্ঠী হিসাবে অভিহিত করেন।
(সংগৃহীত)